তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর বুকে জেগে ওঠা গাইবান্ধার প্রায় ১৬৫ চরে বসবাস করা কয়েক লক্ষাধিক মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস কৃষি। বিস্তীর্ণ চরগুলো একসময় অনাবাদি থাকলেও বর্তমানে কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নের ফলে চরের আঙিনায় শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ফসল।
গত কয়েক দশক ধরে ভুট্টা, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, বাদাম , শসা, ঢেঁঢ়শ চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা।
তবে দুর্বল বিপণন ব্যবস্থার কারণে এ অঞ্চলের কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে পদে পদে ঠকছেন। পাশাপাশি অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেও তারা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।
আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ও সরকারি সহায়তার অভাব, বড় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সংযোগ না থাকা এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে চরের কৃষকদের অল্প লাভেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
গাইবান্ধা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর গাইবান্ধায় ১৭ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে যার ৬৫ শতাংশ চাষ হয়েছে চরাঞ্চলে। অন্যদিকে গাইবান্ধার চরাঞ্চলের প্রায় এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। এর বাজার মূল্য আনুমানিক দেড়শ কোটি টাকা।
গাইবান্ধার বেশ কয়েকটি চরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চরের কৃষি পণ্যের বিপণন ব্যবস্থা এখন সিন্ডিকেটের দখলে ফলে কৃষকরা তাদের কষ্টে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরেজমিনে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার রসুলপুর চরে গিয়ে দেখা যায় প্রখর রোদের মধ্যেই ভুট্টা মাড়াইয়ে ব্যস্ত কয়েকজন কৃষক। ভুট্টার ভালো ফলনে খুশি হলেও দাম নিয়ে হতাশ তারা।
কৃষকরা জানান মৌসুমের শুরুতে ভুটার বাজারদর ছিল মণপ্রতি ১৪শ টাকা। ভরা মৌসুমে এসে দাম পড়ে যায়। কাঁচা ভুট্টা ৮শ থেকে ৯শ টাকা বিক্রি হয়েছে। কাটা-মাড়াইয়ের শেষের দিকে দামের কিছুটা ঊর্ধ্বগতি দেখা গেলেও তা যথেষ্ট নয়। বর্তমানে শুকনা ভুট্টার বাজারদর ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকা মণ (৪০ কেজি)।
ভুট্টা চাষী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ বছর চরের ৬ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছি। জমি চাষ, সেচ ও সার-কীটনাশক, জমির আগাছা পরিষ্কার, ভুট্টা কাটা মাড়াই ও শ্রমিক বাবদ খরচ সব মিলিয়ে তার প্রতি বিঘায় ভুট্টা চাষ করতে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ মণ ভুট্টা পেয়েছেন। এতে খরচ বাদে ২০-২৫ হাজার টাকা বিঘাপ্রতি পাবেন বলে আশা করেন তিনি।
চরে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংগঠনের এক কর্মকর্তা জানান, ধান-গমের মূল্য সরকারিভাবে যেমন নির্ধারিত হয়, ভুট্টার বেলায় হয় না। কম্পানিগুলো তাদের ইচ্ছামতো ভুট্টার দাম নির্ধারণ করে। তাহলে কৃষক সঠিক মূল্য পাবে কিভাবে? বড় কম্পানিগুলোর নিজেদের বেঁধে দেয়া মূল্য অনুযায়ী সারা দেশে ভুট্টা ক্রয়-বিক্রয় হয়। দাম কম হওয়ার এটা অন্যতম কারণ।
স্থানীয় ভুট্টা ব্যবসায়ীদের বক্তব্য- মোকাম বা বড় কোম্পানিগুলো থেকে যে দাম নির্ধারণ করে তারা সেই মূল্যে ক্রয় করেন। এখানে দাম কম দেয়ার বা বেশি দেয়ার সুযোগ নেই। যা কিছু হয় সেখান থেকেই হয়। এদিকে বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় চরের অন্যতম অর্থকরী ফসল মিষ্টি কুমড়া চাষ করেও ন্যায্য দাম না পেয়ে ঠকছেন চাষিরা।
কোচখালী চরের মিষ্টি কুমড়া চাষি আব্দুল হামিদ জানান, স্থানীয় বড় আড়ৎদার আমাদের কাছ থেকে মিষ্টি কুমড়া কেনে প্রতি পিস ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকায়। অথচ খুচরা বাজারে মিষ্টি কুমড়া বিক্রি হয় কেজি দরে।
চরের প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হওয়া মরিচের দাম নিয়েও হতাশ থাকতে হয় কৃষকদের। স্থলভাগ থেকে ভঙ্গুর যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে মরিচ চাষিরা কাঁচা মরিচ বিক্রি করতে পারে না। ফলে জমি থেকে মরিচ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে স্থানীয় ফুলছড়ি বাজারে সপ্তাহে দুদিন বসা লাল মরিচের হাটে এসে মরিচ বিক্রি করতে হয় চাষিদের।
দেশের অন্যতম বৃহৎ এই শুকনো মরিচের হাটে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মরিচ বিক্রি হলেও দালাল, হাট কমিটির অতিরিক্ত খাজনার চাপে চরের সাধারণ চাষিরা কোনঠাসা হয়ে নামমাত্র লাভে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
গাইবান্ধার চর নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের কো অর্ডিনেটর আব্দুস সালাম বলেন, বড় উদ্যোক্তা কিংবা ব্যাপারীদের সঙ্গে সংযোগ তৈরির জন্য অধিকাংশ চরাঞ্চলে কোনো বাজার গড়ে ওঠেনি। তার মতে, সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থা ও বড় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কৃষকের সংযোগ করিয়ে দিলে চরের চাষিরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবে।
টিএইচ